স্ত্রী মিতুকে হত্যা করার জন্য অস্ত্র কিনতে টাকাও দেন বাবুল আক্তার
স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে হত্যা করার জন্য অস্ত্র কিনতে টাকাও দিয়েছিলেন সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তার। তাঁর নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে বিশ্বস্ত সোর্স মুছা সিকদার ও এহতেশামুল হক ওরফে ভোলা সহযোগীদের নিয়ে মিতুকে হত্যা করেন। এমনই তথ্য উঠে এসেছে মিতু হত্যা মামলার আসামি এহতেশামুল হক ভোলার ১২ পৃষ্ঠার জবানবন্দিতে।
গতকাল শনিবার বিকেলে চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম শফি উদ্দিনের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এ তথ্য জানান ভোলা। চট্টগ্রাম মহানগরীর বাকলিয়ার বাসিন্দা ভোলা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে গত শুক্রবার বেনাপোল থেকে গ্রেপ্তার হন। এরপর তাঁকে চট্টগ্রামে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেন পিবিআইয়ের পরিদর্শক ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সন্তোষ কুমার চাকমা।
জিজ্ঞাসাবাদের পর ভোলা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে রাজি হলে বিকেলে চট্টগ্রাম হাকিম আদালতে পাঠানো হয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত জবানবন্দি দেন তিনি। শেষে তাঁকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন মহানগর হাকিম শফি উদ্দিন।
ভোলা আদালতে মিতু হত্যার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন পিবিআইয়ের প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার। তিনি বলেন, হত্যার পরিকল্পনা ও অস্ত্র সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন ভোলা, কিন্তু তদন্তের স্বার্থে এখনই তা প্রকাশ করা যাচ্ছে না।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সন্তোষ চাকমা বলেন, আসামি যে তথ্য দিয়েছেন, তা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
আদালত সূত্র থেকে পাওয়া জবানবন্দির ভাষ্য অনুযায়ী, মিতু হত্যার আদ্যোপান্ত বলেছেন ভোলা। মিতু হত্যায় সরাসরি অংশ নেওয়া মুছা সিকদার ছিলেন তাঁর (ভোলার) কর্মচারী। ভোলার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে মুছাকে চাকরি দিয়েছিলেন বাবুলের অনুরোধে। বাবুল দ্বিতীয় দফায় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশে অতিরিক্ত উপকমিশনার পদে যোগ দেওয়ার পর আবার ভোলা ও মুছার সঙ্গে যোগাযোগ হয়। এক পর্যায়ে বেকার মুছাকে চাকরি দিতে ভোলাকে অনুরোধ করেন বাবুল। তাঁরা দুজনই বাবুলের সোর্স হিসেবে কাজ করতেন। এর মধ্যে একটি অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে সাফল্য দেখিয়ে পুরস্কার জেতেন পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল।
ভোলা জবানবন্দিতে আরো বলেছেন, ‘একদিন মুছা আমাকে বলে, ‘স্যারের সঙ্গে ম্যাডামের সমস্যা হচ্ছে। ম্যাডামকে শেষ করতে বলেছেন স্যার।’ এই বিষয়ে আমার সহযোগিতা চায় মুছা।” মুছার মুখে এমন কথা শুনে ভোলা বলেন, ‘এটা তাঁদের পারিবারিক সমস্যা। এতে তুমি নাক গলাচ্ছ কেন? জবাবে মুছা স্যারকে (বাবুল) ভালোবাসার কথা বলেন। কিন্তু সহযোগিতা করতে রাজি হয়নি আমি। এতে কিছুটা ক্ষুব্ধ হয় মুছা। বিষয়টি বাবুল আক্তারকে জানায় মুছা।’ ভোলা সহযোগিতা করতে চাননি—এমন তথ্য জেনে ক্ষুব্ধ হন বাবুল। এরপর ভোলাকে ডেকে পাঠান। তখন বাবুল বলেন, ‘সহযোগিতা করবে না, ভালো কথা, কিন্তু তুমি তো পরিকল্পনা জেনে গেছ। যদি কাউকে বলো তাহলে ঝামেলা হবে।’
এরপর ভোলা রাজি হন মুছাকে সহযোগিতা করতে। পরে মুছা একদিন ভোলাকে গিয়ে বলেন, ‘স্যার অস্ত্র কিনতে টাকা দিয়েছেন।’ এই টাকায় অস্ত্র সংগ্রহ করা হয়।
কিন্তু ভোলার জবানবন্দির এই তথ্যে কিছুটা গরমিল আছে। এর আগে গ্রেপ্তার হওয়া আসামি ওয়াশিম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানিয়েছিলেন, ভোলা নিজেই অস্ত্রের ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু ভোলা নিজেকে বাঁচাতে মুছার ওপর দায় চাপিয়ে জবানবন্দি দিয়েছেন।
২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে হত্যায় সরাসরি অংশ নেন মুছাসহ তিনজন। হত্যার পর মুছা কয়েক দফা ফোন করেন ভোলাকে। কিন্তু ঘুমে থাকায় ভোলা ফোন ধরতে পারেননি। ঘুম থেকে উঠে টিভি স্ক্রলে মিতু হত্যার তথ্য জানেন। এরপর মুছাকে ফোন দেন। বিকেলে তাঁদের দেখা হয় এবং মুছা অস্ত্র ফেরত দেন। এই অস্ত্র ভোলা তাঁর অন্য কর্মী মনিরকে রাখতে দিয়েছিলেন। সেই অস্ত্র পরবর্তী সময়ে পুলিশ উদ্ধার করে এবং আলাদা একটি অস্ত্র মামলা করে। মামলাটি এখন বিচারাধীন। এই অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়টি ভোলার জবানবন্দিতেও উঠে এসেছে।
ভোলার জবানবন্দি অনুযায়ী, সরাসরি হত্যায় অংশ নেননি ভোলা তবে তিনি জানতেন। অস্ত্রের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এ ছাড়া হত্যার পর অর্থের লেনদেন সম্পর্কেও ভোলা তথ্য দিয়েছেন। কিন্তু তিনি নিজে কোনো টাকা পাননি বলে দাবি করেছেন।
মিতু হত্যার পর দায়ের করা বাবুলের মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ভোলা। একই সঙ্গে তিনি অস্ত্র মামলায়ও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। শেষে আদালত থেকে জামিনও পেয়েছিলেন। এরই মধ্যে পিবিআই বাবুল আক্তারের করা মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিলে গত ১২ মে নতুন করে মামলা করেন মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন। ওই মামলায় বাবুলকে প্রধান আসামি করা হয়। একই সঙ্গে নিখোঁজ মুছা, ভোলাসহ আটজনকে আসামি করা হয়। নতুন করে দায়ের হওয়া হত্যা মামলায় বাবুল গ্রেপ্তার হয়ে এখন ফেনী কারাগারে আছেন।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে ছেলেকে স্কুলের বাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে জিইসির মোড় এলাকায় দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাত ও গুলিতে নিহত হন মিতু। হত্যায় সরাসরি অংশ নেওয়া রাশেদ ও নুরুন্নবী পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যান।