নিরপেক্ষতায় এগিয়ে আমরা...

রবিবার, সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৪

লজ্জায় অবনত দেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক, যশোর ৬ অক্টোবর,২০২০

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার একলাসপুর ইউনিয়নে অনৈতিক কাজের অপবাদ দিয়ে এক নারীকে (৩৬) বিবস্ত্র করে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করেছে একদল যুবক। নির্যাতনকারীদের বার বার বাবা ডেকেও শেষরক্ষা হয়নি ওই নারীর। গত রোববার দুপুর থেকে নির্যাতনের এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। দেশের সচেতন নাগরিকরা লজ্জা আর অপমানে ক্ষোভে ফেটে পড়েন।

রাজধানীসহ দেশের অনেক জেলায় মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচিও পালিত হয়েছে। শুরু হয় প্রতিবাদের ঝড়। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ ও র্যাবের অভিযানে রাতেই ৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরই মধ্যে ভিডিওটি সরিয়ে নিতে উচ্চ আদালত নির্দেশনাও দেন।

জানা যায়, তিন বছর আগে ওই নারীর বিয়ে হয়। বিয়ের কিছুদিনের মধ্যে তার স্বামী আরো একটি বিয়ে করলে তাদের মধ্যে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। গত ২ সেপ্টেম্বর রাতে ওই নারীর আগের স্বামী তার সঙ্গে দেখা করতে তার ঘরে ঢোকেন। বিষয়টি দেখে ফেলে স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ী ও দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ার। রাত ১০টার দিকে দেলোয়ার তার লোকজন নিয়ে ওই নারীর ঘরে প্রবেশ করে। পরে অনৈতিক কাজের অভিযোগ এনে ওই নারীকে মারধর শুরু করেন। একপর্যায়ে পিটিয়ে নারীকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করে।

ভিডিওটিতে দেখা যায়, ওই গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে তাকে মারধর করে অভিযুক্তরা। এ সময় গৃহবধূ চিৎকার করলেও বন্ধ হয়নি তাদের নির্যাতন।

ভিডিওচিত্র দেখা স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি বলেন, স্থানীয় দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ার ও তার সেকেন্ড ইন কমান্ড বাদল, কালাম, সাইফুদ্দিন, রহিম ও সুমনসহ ৬-৭ যুবক ওই নারীর ওপর এ নির্যাতন চালিয়েছে। নির্যাতনকারী দেলোয়ার ও তার বাহিনীর লোকজনের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় এলাকাবাসী। রাতেই পুলিশ ওই নারীকে উদ্ধার করে। পরে এ ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের হয়।

র্যাব ও পুলিশের অভিযান : ৪ সেপ্টেম্বর দুপুরের দিকে ঘটনার ধারণ করা ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর রাতেই ওই মহিলাকে উদ্ধার করে ৯ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের হয়। মামলার পরপরই আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযানে নামে র্যাব ও পুলিশ।

পুলিশের অভিযানে রাতেই গ্রেপ্তার হয় উপজেলার একলাসপুর ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের জয়কৃষ্ণপুর গ্রামের খালপাড় এলাকার হারিদন ভূঁইয়া বাড়ির শেখ আহম্মদ দুলালের ছেলে মো. রহিম (২০) ও একই এলাকার মোহর আলী মুন্সিবাড়ির মৃত আবদুর রহিমের ছেলে মো. রহমত উল্যাহ (৪১)।

বেগমগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হারুন উর রশীদ চৌধুরী বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, পুলিশের ৫টি ইউনিট ৭ ঘণ্টা ধরে অভিযান চালিয়ে দুই আসামি আটক করেছে।

র্যাবের অভিযানে রোববার দিনগত রাত আড়াইটার দিকে র্যাব-১১ সিদ্ধিরগঞ্জের চিটাগাং রোড এলাকা থেকে দেলোয়ারকে গ্রেপ্তার করে।

পরে তার দেওয়া তথ্যে ভোর সাড়ে ৫টায় ঢাকা জেলার কামরাঙ্গীরচর ফাঁড়ির গলি এলাকা থেকে ঘটনার প্রধান আসামি মো. নুর হোসেন বাদলকে গ্রেপ্তার করা হয়।

র্যাব-১১ অধিনায়ক লে. কর্নেল খন্দকার সাইফুল আলম জানান, মামলার পর থেকেই র্যাব ব্যাপকভাবে গোয়েন্দা নজরদারি শুরু করে। র্যাব অস্ত্রসহ প্রথমেই রাতে আটক করে সন্ত্রাসী দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ার হোসেনকে। পরে তার দেওয়া তথ্যে ঢাকা জেলার কামরাঙ্গীরচর ফাঁড়ির গলি এলাকা থেকে মো. নুর হোসেন বাদলকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনার দায় স্বীকার করেছেন আটককৃতরা।

র্যাব জানায়, ‘দেলোয়ার বাহিনী’ এলাকায় চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা এবং নানান সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত এবং দেলোয়ার এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী। তাদের ভয়ে এলাকার লোকজন ভীতসন্ত্রস্ত। এ ঘটনায় জড়িত অন্যান্য অপরাধীকে গ্রেপ্তারে র্যাবের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

উত্তাল রাজপথ : এদিকে সারা দেশে সংঘটিত ধর্ষণ-নিপীড়নের ঘটনায় বিচারের দাবিতে গতকাল সোমবার সারাদিনই রাজধানী ঢাকার শাহবাগ, উত্তরা, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ঘটনাস্থল নোয়াখালীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সমাবেশ থেকে এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। পাশাপাশি দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করা হয়। বিকালে রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন সম্মিলিত ছাত্র-জনতা।

জাতীয় জাদুঘরের সামনে বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের সমাবেশে নেত্রকোনার নেত্রী মাকসুরা আক্তার বলেন, ‘রাস্তায় নেমে আসতে হবে। সরকারকে জানান দিতে হবে এভাবে আর চলতে পারে না। এই সরকারের কাছে মা-বোন সুরক্ষা পাচ্ছেন না। কেন আমার মা-বোনরা একে একে ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন, শ্লীলতাহানির শিকার হচ্ছেন। ধিক্কার ধিক্কার এই সরকারকে।’ বিক্ষোভ সমাবেশে শ্রমিক অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক আবদুর রহমান বলেন, ‘আমরা ধর্ষিত হয়েছি ২০১৮ সালের নির্বাচনেও। সে সময় সুবর্ণচরে নারী ধর্ষণের ঘটনার বিচার হয়নি। দীর্ঘদিনের বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে এই রাষ্ট্রে ধর্ষণ-শ্লীলতাহানির বিচার হয় না।’

ছাত্র অধিকার পরিষদ নেতা শহীদুল হক বলেন, ‘প্রতিবারই আমরা বিচারের দাবিতে রাস্তায় নামি, তারপর টনক নড়ে। এবার নোয়াখালীর নারী ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা ৩২ দিন আগের। এতদিন কিছুই হয়নি জড়িতদের। যখন বিষয়টি সোশ্যাল মিডিয়ায় আসে, প্রতিবাদ শুরু হলো, তখন টনক নড়ল। ধর্ষক গ্রেপ্তার হলো। গ্রেপ্তারদের ছবি কাদের সঙ্গে দেখা যায়, সরকারদলীয় লোকজন, স্থানীয় এমপির সঙ্গে। আমরা মানবিক রাষ্ট্র চাই। মা-বোনের সম্ভ্রম রক্ষায় মানবিক পুলিশ চাই।’

আদালতের আদেশ

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে থাকা ভিডিও ফুটেজটি সরাতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। সিডি বা পেনড্রাইভে কপি রেখে ভিডিও ফুটেজ সরাতে বিটিআরসির চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ওই নারীর পরিবারকে সব ধরনের নিরাপত্তা দিতে নোয়াখালীর পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ঘটনাটি আাাদালতের নজরে আসার পর সোমবার বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীমের ভার্চুয়াল বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন।

একইসঙ্গে ঘটনার বিষয়ে ভিকটিমের বক্তব্য গ্রহণে পুলিশের কোনো অবহেলা আছে কি না তা অনুসন্ধান করতে একটি কমিটি করে দিয়েছেন আদালত। নোয়াখালীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে জেলা সমাজসেবা অফিসার এবং চৌমুহনী সরকারি এসএ কলেজের অধ্যক্ষ তা অনুসন্ধান করে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে হাইকোর্টের রেজিস্ট্রারের কাছে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

ওই ঘটনায় করা ফৌজদারি মামলার সবশেষ অবস্থা জানিয়ে ২৮ অক্টোবর আদালতকে প্রতিবেদন দিতে বেগমগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। 

রুলে ওই নারীকে রক্ষায় এবং দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে অবহেলার কারণে বেগমগঞ্জের ওসি ও বেগমগঞ্জ থানার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট।

দুই সপ্তাহের মধ্যে স্বরাষ্ট্র সচিব, নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক ও বেগমগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

এর আগে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলায় স্বামীকে বেঁধে রেখে গৃহবধূকে নিজ ঘরে ধর্ষণচেষ্টায় বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনা হাইকোর্টের নজরে এনেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা।

আদালতে বিষয়টি নজরে আনেন জেড আই খান পান্না ও আবদুল্লাহ আল মামুন।

পরে আদালতে মতামত তুলে ধরেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন, সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস কাজল, ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, ইয়াদিয়া জামান, জামিউল হক ফয়সাল, রাশিদা চৌধুরী নিলু, তানজীম আল ইসলাম প্রমুখ।

রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নওরোজ রাসেল চৌধুরী।

tags

মন্তব্য

মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন

সব খবর