নিরপেক্ষতায় এগিয়ে আমরা...

বুধবার, এপ্রিল ২৩, ২০২৫

টিকা পেতে উভয়সংকট

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা পেতে সহজ শর্তে চুক্তি করে, আগাম টাকা দিয়েও সরকার এখন প্রাপ্য টিকা না পেয়ে উল্টো জিম্মিদশায় আটকে গেছে। এমন তিক্ত অবস্থার মধ্যে পড়ে রাশিয়া, চীনসহ অন্য মাধ্যমগুলো থেকে টিকা আনার ক্ষেত্রে রীতিমতো উভয়সংকটে পড়েছে সরকার। এসব দেশ বাংলাদেশের টিকাসংকটকে পুঁজি করে টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের ইচ্ছামতো শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। এমনকি দেশে উৎপাদনের ক্ষেত্রেও বাড়তি সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছে।

kalerkanthoবাংলাদেশ শুরুতেই টিকার জন্য শুধু একটি মাধ্যমের ওপর নির্ভর না করে আরো দেশের সঙ্গে চুক্তি করলে এখন এমন সংকটে পড়তে হতো না বলে মনে করছেন অনেকেই। সেই সঙ্গে সরকারের দ্রুত সিদ্ধান্ত দিতে না পারা কিংবা সিদ্ধান্তপ্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগও তোলা হচ্ছে। গতকাল সোমবার চীনা রাষ্ট্রদূতের কথায়ও সেই অভিযোগের নমুনা মিলেছে। দেশীয় বিশেষজ্ঞদের কারো কারো একই অভিমত। তবে অনেকে আবার বলছেন, সংকট কাটাতে সরকারের সামনে যেমন জরুরি হচ্ছে যেকোনো উপায়ে টিকার সংস্থান করা, তেমনি জরুরি টিকা আনতে গিয়ে যেনতেন শর্তের ফাঁদে পড়ে আবারও নতুন কোনো সংকটে আটকে যাওয়ার প্রবল ঝুঁকিও রয়েছে সরকারের জন্য। সরকারকে তাই এখন দ্রুত সময়ের মধ্যে অপেক্ষাকৃত সঠিক ও যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে।

বাংলাদেশ ফার্মাকোলজিক্যাল সোসাইটির সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যুদ্ধের সময় অনেক আইন যেমন শিথিল করতে হয়, তেমনি এখন মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য টিকা আনার ক্ষেত্রেও সরকারকে প্রয়োজনে আইনের শক্ত অবস্থান থেকে যতটা সম্ভব সহনশীল অবস্থানে গিয়ে জরুরি ভিত্তিতে টিকা আনতে হবে। চীন বা রাশিয়া যেভাবে অন্য ৬০-৬২টি দেশকে টিকা দিয়েছে বা দেওয়ার জন্য প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছে, বাংলাদেশেরও সেই পথে থাকা উচিত। কারণ আমরা এমনিতেই দেরি করে ফেলেছি। আরো দেরি করলে দামও বেড়ে যাবে এবং সংকটও আরো বাড়বে—এটাই এখনকার বাস্তবতা।’ একই সঙ্গে সরকারকে কোভ্যাক্সের সঙ্গে আরো জোরালো যোগাযোগের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘কোভ্যাক্স থেকে এ মাসে মাত্র এক লাখ ডোজ ফাইজারের টিকা আসবে—এটা একেবারেই হাস্যকর ব্যাপার। সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের মাথায় রাখা উচিত, আমরা এই টিকা কোনো পাইলট প্রগ্রামের জন্য আনছি না, আনছি গণটিকা হিসেবে ব্যবহারের জন্য। আমাদের অ্যাপ্রোচ সেভাবেই রাখতে হবে।’

সূত্র জানায়, দেশে টিকা উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়াতেও ভেতরে ভেতরে কাজ চলছে। আগে থেকে দেশের যে তিনটি কম্পানি অন্যান্য টিকা উৎপাদনে পারদর্শী ছিল, সেগুলোকে আরো শক্তিশালী করা এবং নতুন আরো দু-তিনটি কম্পানিকে টিকা তৈরির জন্য অবকাঠামোসহ প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে প্রস্তুত করার চেষ্টা চলছে। অবশ্য আপাতত দেশে চীন ও রাশিয়ার টিকা উৎপাদনের যে কথা চলছে, সে অনুযায়ী ওই দুই দেশ থেকে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কম্পানিকে কারিগরি সহযোগিতা দেওয়ার বিষয়টি আলোচনায় রয়েছে। সেই সঙ্গে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তির প্রক্রিয়া দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার জন্য কাজ চলছে।

টিকাসংক্রান্ত কমিটির একজন পদস্থ সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, সেরামের সঙ্গে চুক্তিটি সরাসরি জিটুজি পদ্ধতির ছিল না, সেখানে বেসরকারি বাণিজ্যিক ভিত্তি বেশি ছিল। কিন্তু এখন রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে চুক্তি হতে যাচ্ছে সম্পূর্ণ জিটুজি। ফলে এই চুক্তি আগের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর। কোনো ভুল হয়ে গেলে দুই রাষ্ট্রের সম্পর্কের ওপর প্রভাব পড়ার ঝুঁকি থাকে। ফলে এখানে আইনগত দিকগুলোতে অনেক বেশি নজর রাখতে হচ্ছে।

এদিকে বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং গতকাল সকালে নিশ্চিত করেছেন, আগামীকাল বুধবারই ঢাকায় পৌঁছবে সিনোফার্ম টিকার পাঁচ লাখ ডোজ। চীন এগুলো উপহার হিসেবে দিচ্ছে। তিনি বলেন, চীন সিনোভ্যাকের টিকা দেওয়ার প্রস্তাব দিলেও বাংলাদেশ জরুরি ভিত্তিতে এই টিকা পেতে এখনো অনুমতি দেয়নি। বাংলাদেশ শুধু সিনোফার্মকে অনুমোদন দিয়েছে। তাই শিগগিরই সিনোভ্যাকের টিকা পাওয়ার সম্ভাবনা কম। আবার সিনোর্ফামের টিকার বিষয়ে বাংলাদেশ সিদ্ধান্ত নিতে তিন মাস দেরি করায় ওই টিকা কেনার বিষয়টিও পেছনে পড়ে গেছে।

ঢাকায় চীন দূতাবাস গতকাল বিকেলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, বুধবার সিনোফার্ম কভিড-১৯ টিকার পাঁচ লাখ ডোজ ঢাকায় আসছে। মানুষের কল্যাণে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের অঙ্গীকারকে সম্মান জানিয়ে এই টিকা পাঠানো হচ্ছে। এটি বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতা ও কৌশলগত সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ।

চীন দূতাবাস জানায়, কভিডের বিরুদ্ধে সিনোফার্ম টিকার কার্যকারিতা ৭৯ শতাংশ। এই টিকা সংরক্ষণ করাও সহজ। এই টিকার সিসির ওপর ‘ভায়াল মনিটর’ থাকে। কোনো কারণে টিকা বেশি তাপমাত্রার মধ্যে পড়লে এর রং বদলে যায়। এতে স্বাস্থ্যকর্মীরা বিষয়টি বুঝতে পারেন।

চীন দূতাবাস জানায়, চীন গত ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশকে টিকা উপহার দিতে চেয়েছিল। কিন্তু ঢাকায় চীন দূতাবাস গত ৩০ এপ্রিলের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে জরুরি ব্যবহারের সম্মতিপত্র পায়নি। এখন বাংলাদেশে টিকার ব্যাপক চাহিদা ও আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহের প্রবল চাপের কারণে চীন যত দ্রুত সম্ভব এ দেশে টিকা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। চীনে মে দিবসের ছুটির মধ্যেও অনেক চীনা কর্মী বাড়তি কাজ করে এবং সন্তুষ্টি নিয়েই দুই সপ্তাহের মধ্যে এসব টিকা উৎপাদন করেছেন।

এদিকে রাশিয়ার টিকা নিয়েও জটিলতা তৈরি হয়েছে। রাশিয়ার প্রস্তাবিত চুক্তির খসড়াকে একতরফা মনে করছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। রাশিয়া কোনো কারণে কভিডের টিকা সরবরাহ করতে না পারলে টাকা ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা চায় বাংলাদেশ। টিকা সরবরাহে জটিলতা হলে তার দায় রাশিয়াকে নিতে হবে। রাশিয়ার সঙ্গে প্রস্তাবিত চুক্তির বিষয়ে এমন ২৯টি সুপারিশ করেছে আইন মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া টিকা নেওয়ার পর কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের দায়মুক্তির ধারাটি পর্যালোচনারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

রাশিয়ার প্রস্তাবিত চুক্তিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ‘একতরফা’ মনে করছে—এমন ইঙ্গিত দুই সপ্তাহ আগেই দিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেককে পাল্টা খসড়া প্রস্তাব দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। পাশাপাশি তিনি এ-ও বলেছিলেন, টিকার ঘাটতি থাকায় এখন সুবিধাজনক অবস্থায় আছে টিকা উৎপাদনকারীরা। চুক্তির বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত না নিলে জটিলতারও আশঙ্কা আছে।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সম্প্রতি রাশিয়ার টিকা স্পুিনক ভি দেশে প্রয়োগে অনুমোদন দেয়। রাশিয়া থেকে প্রথম চালানেই ১০ লাখ ডোজসহ যতটা সম্ভব বেশি টিকা কিনতে আগ্রহী বাংলাদেশ। কিন্তু দেশটির পক্ষ থেকে প্রতি ডোজ টিকার দাম এবং অন্য কয়েকটি শর্তসহ যে খসড়া চুক্তি বাংলাদেশের কাছে পাঠানো হয়েছে, তা মানতে নারাজ বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ। টিকার প্রতি ডোজের দাম ধরা হয়েছে ১০ ডলার। এ ছাড়া শর্ত দেওয়া হয়েছে—দামের অর্ধেক অর্থ অগ্রিম দেওয়া, কোনো কারণে টিকা সরবরাহে দেরি হলে এবং টিকার মান বা কার্যকারিতা কমে গেলে কোনো দায় সরবরাহকারী অর্থাৎ রাশিয়াকে দেওয়া যাবে না। এসব শর্তের কারণে কবে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি হবে বা হবে কি না তা নিশ্চিত নয়। তবে বাংলাদেশ এখনো আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।

এদিকে করোনার টিকা এখন অন্য দেশকে সহযোগিতা হিসেবে দেওয়ার চেয়ে উচ্চ মুনাফার বাণিজ্য হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে। সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা কোভিশিল্ডের প্রতি ডোজ বাংলাদেশ কিনেছে পাঁচ ডলারে। চীনের সিনোফার্মের প্রতি ডোজ টিকা থাইল্যান্ডে পাঁচ ডলার হলেও ইন্দোনেশিয়ায় তা ১৭ ডলার। শুরুর দিকে সিনোফার্মের টিকা সেনেগালসহ আফ্রিকার বহু দেশ এবং অন্যরা পেয়েছে ৩.৭ ডলার থেকে চার ডলারে। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে সিনোফার্মের টিকা সাত ডলার বা তারও অনেক বেশি।

চীন ও রাশিয়ার কাছ থেকে টিকা কেনার প্রস্তাবে বাংলাদেশ এত দিন কেন সাড়া দেয়নি, জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন কালের কণ্ঠকে বলেছেন, ‘পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া। সেটি তারা করেছে। সিদ্ধান্ত নেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আমাদের মেডিক্যাল বিশেষজ্ঞরা তখন বলেছিলেন, চীন-রাশিয়ার টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পায়নি। পরবর্তী সময়ে ভারত থেকে টিকা আসতে দেরি হওয়ায় বিকল্প উৎসর খোঁজ চলছে। এরই মধ্যে চীনের সিনোফার্মের টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পেয়েছে।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, টিকা কবে, কখন, কিভাবে, কার কাছ থেকে, কী দামে আনা হবে সেই সিদ্ধান্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ভারতের কাছে অন্তত দ্বিতীয় ডোজের অপেক্ষমাণদের জন্য টিকা আগে পাঠাতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে তিনি চিঠি লিখেছেন। এ ছাড়া তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে বলেছেন জরুরি ভিত্তিতে অ্যাস্ট্রাজেনেকার ৪০ লাখ ডোজ টিকা পাঠাতে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তিনি দুই কোটি ডোজ টিকা চেয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র কী বলেছে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বলেছেন যে তিনি চেষ্টা করছেন। ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতও চেষ্টা চালাচ্ছেন। এ ছাড়া প্রবাসী বাংলাদেশিদেরও এ বিষয়ে কাজ করতে বলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো সুখবর নেই। যুক্তরাষ্ট্র কভিডের কোনো টিকা বিদেশে রপ্তানি করেনি, ভারতকেও দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, খাদ্য ও ওষুধ কর্তৃপক্ষের (এফডিএ) অনুমতি ছাড়া তারা কোনো ওষুধ, টিকা বিদেশে পাঠাতে পারবে না। আর ওই অনুমতি বেশ সময়সাপেক্ষ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত তাদের জানিয়েছেন যে বাংলাদেশ ও ভারত একই সময়ে কভিডের টিকা পেতে পারে বলে তিনি আশা করছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (টিকা) ডা. শামসুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ১২ মে চীনের পাঁচ লাখ ডোজ টিকা আসা এখন নিশ্চিত। সেই সঙ্গে এ মাসে কোভ্যাক্স থেকে এক লাখ ডোজ আসছে। বাকি কোন টিকা কবে কিভাবে আসবে তার কোনো নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না।

tags

মন্তব্য

মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন

সব খবর