নিরপেক্ষতায় এগিয়ে আমরা...

মঙ্গলবার, মে ১৩, ২০২৫

গয়নার গ্রাম ভাকুর্তা

নিজস্ব প্রতিবেদক, যশোর ১৭ জানুয়ারী,২০২১

বাঙালি নারীর সৌন্দর্যের অন্যতম উপকরণ অলংকার। নারী আর অলংকার যেন একে অপরের পরিপূরক। অলংকার শব্দটি কিছুটা ভারী হওয়ায় লোকমুখে এর প্রচলিত নাম গয়না। ঢাকার নিউমার্কেটে গেলে দেখা মিলবে সারি সারি গয়নার দোকান। বাহারি রঙের, নিখুঁত নকশার এসব গয়নার অধিকাংশই কিন্তু আমাদের দেশের কারিগরদের হাতেই তৈরি।

 

 

 

রাজধানীর অদূরে সাভারের ভাকুর্তা গ্রাম। ঐ গ্রামকে এখন সবাই গয়নার গ্রাম নামেই চিনে। তবে ঐ গ্রামের গল্পটা বেশ পুরনো। সেখানকার কারিগররা প্রায় ৩০০ বছর ধরে বংশ পরম্পরায় গয়না তৈরির পেশায় যুক্ত। এ গ্রামের অসংখ্য পরিবার গয়না তৈরি করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করছে। ১৯৯০ সালের দিকে স্বর্ণের দাম বাড়ায় এ ধাতুর চাহিদা কমে যায়। সেই জায়গাটা দখল করে নেয় রূপার গয়না। রূপার দামও বেড়ে গেলে লোকসানে পড়েন কারিগররা।

 

 

 

এরপর তারা তৈরি করতে শুরু করেন পিতল ও তামার গয়না। যা সারাদেশ ছড়িয়ে পড়েছে। রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনাল পার হলেই আমিন বাজারের পথ। সেই পথ ধরে এগুলেই হাতের বাম দিকে পুরাতন বেইলি ব্রিজ। সেই ব্রিজ পার হলেই ভাকুর্তা গ্রাম। সবুজে ঘেরা এই গ্রাম ঘিরে গড়ে উঠেছে ‘গয়নাশিল্প’। এই গ্রামের গয়নাশিল্পীরা তাদের বাপ-দাদার পেশাকেই ধরে রেখেছেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম। ভাকুর্তা বাজারে ঢুকতেই চোখে পড়বে সারি সারি গয়নার কারখানা। হাতুড়ি আর গ্যাস বার্নারের শব্দে মুখরিত পুরো এলাকা। একদিকে চলছে ছাঁচে গয়নার নকশার অবয়ব তৈরির কাজ, অন্যদিকে কাঠ কয়লার আগুনে পুড়িয়ে চলছে সেই গয়না শক্ত করার কাজ। গ্রামের প্রতিটা ঘরে ও দোকানে কারিগররা এক মনে বানিয়ে যাচ্ছেন নানা নকশার গয়না, সেগুলো আবার বিভিন্ন ধরনের রঙিন পাথর ও পুঁতি বসিয়ে ডিজাইন ফুটিয়ে তোলার কাজ করছেন নারী ও পুরুষ শিল্পীরা।

 

 

 

পেশাটি প্রাচীন হলেও গয়না তৈরিতে প্রাচীন পদ্ধতির পরিবর্তে এসেছে আধুনিকতা। ফু দেওয়া নলের পরিবর্তে ব্যবহূত হচ্ছে গ্যাস বার্নার আর কয়লার পরিবর্তে হাওয়া দিতে এসেছে হাপর যন্ত্র। তবে কাঁচামাল আমদানি ও দাম বৃদ্ধির কারণে ঐ গ্রামের কারিগররা পাল্লা দিয়ে পেরে উঠছেন না। ভাকুর্তাসহ আশপাশের ৩০টি গ্রামের মানুষই গয়না তৈরির পেশার সঙ্গে জড়িত। আগে মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা এই পেশার সঙ্গে জড়িত থাকলেও কালের বিবর্তনে এবং লাভ বেশি হওয়ায় গ্রামের সব সম্প্রদায়ের মানুষই এখন গয়না তৈরির কাজে যুক্ত হয়েছেন।

 

 

 

সরেজমিনে জানা গেছে, ভাকুর্তা, কান্দিভাকুর্তা, হিন্দুভাকুর্তা, মোগরাকান্দা, মুশুরিখোলা, ডোমরাকান্দা, বাহের চর, ঝাউচর, লুটের চর, চুনার চর, চাপড়া, চাইরাসহ বিভিন্ন গ্রামের প্রায় ১০ হাজার লোক গয়না তৈরির কাজে যুক্ত। এখানে তৈরি হয় মাথার টিকলি, টায়রা, ঝাপটা, মুকুট, কানের দুল, ফুল, ঝুমকা, গলার মালা, হার বা নেকলেস, হাতের বালা, চূঁড়, চুড়ি, ব্রেসলেটসহ নানা গয়না। এই গয়নাগুলো গ্রাম থেকে পাইকারদের হাত ধরে চলে যায় রাজধানীর নিউমার্কেট, চাঁদনী চক, গাউছিয়াসহ সারা দেশের প্রায় সব বিপণিবিতানে। জানা যায়, প্রতি পিস নেকলেস ৩০০ থেকে হাজার টাকার মধ্যে বিক্রি হয়। এছাড়া চুড়ির জোড়া ২০০ থেকে ৩০০ টাকা, সীতাহার ৬০০ থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা, নুপুর ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, নাকফুল ২০ থেকে ৩৫ টাকা এবং টিকলি ৮০ থেকে ১০০ টাকা। তবে গয়নাগুলো পাইকারদের কাছে বিক্রি করা হয় অপরিশোধিত অবস্থায়। পরে পাইকাররা পরিশোধন করে মার্কেটে দেড় থেকে দুইগুণ বেশি দামে খুচরা বিক্রি করেন।

 

 

 

গয়না কারিগর রফিকুল আলম জানান, আমরা মাথার টায়রা, কানের দুল, নাকের নথ, গলার হার, হাতের ব্রেসলেট, কোমরের বিছা ও পায়ের নূপুর থেকে শুরু করে নারীদের সব ধরনের গয়না তৈরি করি। আমরা গয়না গড়ে দেই। সেই গয়না পলিশসহ রঙের কাজ হয় রাজধানীর তাঁতীবাজারে। সেখান থেকে গয়না সরবরাহ হয় সব বিপণিবিতানে। তবে তামা, পিতলের কিছু গয়না এখানেও ফিনিশিং করে বিক্রি করা হয়। আর নকশাসহ অর্ডার করলে এখান থেকেই বানিয়ে দেওয়া হয় পছন্দসই রুপার গয়না।

 

 

 

স্ব্বর্ণ ও রৌপ্য ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি ও আল-হেরা জুয়েলার্স অ্যান্ড ওয়ার্কশপের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, এ শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করতে হয় ভারত থেকে। কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় কারিগরেরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। সরকার পৃষ্ঠপোষকতা দিলে দেশীয় এই শিল্পের কারিগররা নিজ পেশায় থেকে লাভবান হতে পারত। তাদের আর পেশা বদল করতে হতো না। ক্রেতাদের পাশাপাশি সরকারের সহযোগিতা পেলে এ শিল্প বেঁচে থাকবে বলে তার প্রত্যাশা।

 

 

 

গয়নার কারিগর আলমগীর হোসেন বলেন, ‘একটা সময় এত অর্ডার পেতাম যে, আমরা দোকানের কারিগররা মিলে সেই কাজ সময়মতো তৈরি করতে পারতাম না। বাধ্য হয়ে ঘরের নারীদের লাগাতাম কাজে। নারীরা বাড়ির কাজের পাশাপাশি আমাদের কাজে সহায়তা করতেন। বর্তমানে বেচা-কেনার অবস্থা এতটাই খারাপ যে, আমরা কারিগররা কাজই পাই না। অনেক কারিগর আছেন, যারা পেশা বদল করেছেন।’

 

 

 

অন্য একজন কারিগর হূদয় হোসেন বলেন, ‘রুপার চেয়ে তামা-পিতলের গয়না বিক্রিতে লাভ বেশি। আমরা গয়না তৈরির কাঁচামাল নিয়ে আসি ভারত থেকে। চায়নার কিছু অলংকার দেশে ঢুকে যাওয়ায় আমাদের এ পণ্যের চাহিদা অনেকটাই কমে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে রুপার মতো এক সময় পিতল ও তামার তৈরি গয়নার ব্যবসাও লাটে উঠবে।’

tags

মন্তব্য

মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন

সব খবর