আর কত দেরি অ্যান্টিজেন টেস্ট
করোনাভাইরাস অ্যান্টিজেন টেস্ট নিয়ে নাটকীয় পট পরিবর্তন। করোনাবিষয়ক জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি দেশে অ্যান্টিজেন টেস্ট শুরু করার কথা বললে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) অনুমোদনের অজুহাত দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ডাব্লিউএইচও অ্যান্টিজেন টেস্টের অনুমোদন দেয়ায় বিশ্বের অন্য দেশে অ্যান্টিজেন কিট সংগ্রহ হুড়াহুড়িতে বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে। এখনও কিট সংগ্রহ করতে পারেনি। বিশ্বে কিটের চাহিদা বাড়ায় বাংলাদেশ অ্যান্টিজেন কিট আমদানি সংকট হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।
মুগদা জেনারেল হাসপাতালের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ কাশেম সংবাদকে বলেন, মানুষের শরীর থেকে রক্ত নিয়ে তা থেকে প্লাজমা আলাদা করে কিটের মাধ্যমে ভাইরাস শনাক্ত করার প্রক্রিয়াকে বলা হয় অ্যান্টিজেন টেস্ট। অ্যান্টিজেন কিট যক্ষ্মা নির্ণয়ের ‘জিনএক্সপার্ট’ মেশিনে ব্যবহার করেও করোনার নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব। এই কিটের সবচেয় বড় সুবিধা ১৫ মিনেটে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি নির্ণয় করা যায়।
এ বিষয়ে কোভিড-১৯ জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি গত ৫ জুলাই অ্যান্টিজেন টেস্টের অনুমতি দেয়ার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর। গত ১৭ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মানবদেহে অ্যান্টিজেন্ট টেস্টের অনুমোদন দেয়। অনুমোদনের ১৫ পার হতে যাচ্ছে এখনও কিট সংগ্রহ নিয়ে আলোচনা পর্যায়ে রয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে প্রথম থেকেই সরকার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এগোনি। অ্যান্টিজেন টেস্টের বিষয়ে জনগণকে আশ্বস্ত করছে কিন্তু সমাধান আনতে পারছে না।
জানা গেছে, করোনাভাইরাস (কোভিট-১৯) সংক্রমণ শনাক্তের হার বৃদ্ধি করতে রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (আরটি-পিসিআর) টেস্টের পাশাপাশি সারাদেশে অ্যান্টিজেন টেস্টের অনুমোদন সরকার দিলেও কবে নাগাদ টেস্টিং শুরু হবে তা অনিশ্চিত। অথচ স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রস্তাব এবং বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অন্তর্বর্তীকালীন গাইডলাইন অনুযায়ী সব সরকারি হাসপাতাল, জেলা হাসপাতাল, সরকারি পিসিআর ল্যাব এবং সব স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে অ্যান্টিজেন ভিত্তিক পরীক্ষার অনুমতি দেয়া হয়েছে। করোনাকালীন মহামারীতে অ্যান্টিজেন টেস্টিং এবং আরটিপিসিআর মেশিনে চিকিৎসা কার্যক্রম বিশ্বের অন্য দেশের সঙ্গে মিল রেখে চলতে পারছে না বাংলাদেশ। প্রতিটি পদক্ষেপে দেরি হচ্ছে। এখনও ৩৬টি জেলায় করোনার নমুনা পরীক্ষা করতে আরটিপিসিআর মেশিন বসাতে পারেনি স্বাস্থ্যবিভাগ। আর সরকারি সব প্রক্রিয়া শেষ করতে দেশে অ্যান্টিজেন কিট আসতে বেশ কিছুদিন সময় লাগবে।
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে ঢিলামি ভাব দেখা যাচ্ছে। অ্যান্টিজেন টেস্ট নিয়েও পরিকল্পনাহীন চলছে স্বাস্থ্য বিভাগ। যার প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠেছে- গত ১৭ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দেশে অ্যান্টিজেন টেস্টিংয়ের কার্যক্রম করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এতোদিনেও অ্যান্টিজেন কিটের সুরাহা করতে পারেনি। এখনও আলোচনা পর্যায়ে রয়েছে। বরাবর-ই পরিকল্পনার অভাবে করোনাভাইরাস কার্যক্রম নিয়ে তালগোলে পড়ছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতর জনগণকে আশ্বস্ত করে কিন্তু সমাধান এখন পর্যন্ত আনতে পারেনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কোন কোম্পানির কিট আমদানি করবে এবং কোন প্রক্রিয়ায় তা নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের গঠিত কমিটির সদস্যরা আলোচনা করছেন। কারণ বিশ্বে মাত্র পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের অ্যান্টিজেন কিটের গুণগতমান ভালো। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতর নমুনা কিট সংগ্রহ করে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরে পাঠাবে। নমুনা কিটের কার্যকারিতা ওষুধ প্রশাসন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সন্তোষজনক ফলাফল পেলে কিট আমদানিতে অনাপত্তিপত্র দেবে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে। এসব প্রক্রিয়া শেষ করতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) অ্যান্টিজেন কিটের অনুমোদন দেয়ায় ভারতসহ অনেক দেশ র্যাপিড টেস্ট শুরু করেছে। বাংলাদেশে এখনও কোন হাসপাতালে অ্যান্টিজেন টেস্ট শুরু করতে পারেনি। কারণ ইতোমধ্যে কিটের চাহিদা বিশ্বের সব দেশে বেড়েছে।
অ্যান্টিজেন কিটের বিষয়ে হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্ব্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী সংবাদকে বলেন, করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি আরটিপিসিআর মেশিনের পাশাপাশি অ্যান্টিজেন টেস্টের ব্যবস্থা রাখার পরামর্শ দিয়েছিল। সেই পরামর্শ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দীর্ঘদিন ঝুঁলে রেখে ১৭ সেপ্টেম্বর অ্যান্টিজেন টেস্টের অনুমোদন দিলেও বাস্তবায়ন কবে হবে সংশয় রয়েছে। সরকার ইচ্ছে করলে, পরামর্শক কমিটির সুপারিশ কাজে লাগিয়ে বহু আগেই অ্যান্টিজেন টেস্টের ব্যবস্থা করতে পারত। কিন্তু সেটি করেনি। এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অ্যান্টিজেন টেস্টে শুরু করেছে কিটের সংকট তৈরি হয়েছে। কিট সংগ্রহে দৌড়ে বাংলাদেশ অন্যদেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যেতে পারবে বলে মনে করেন না এই বিশেষজ্ঞ।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংশ্লিষ্টরা জানান, কয়েকটি কোম্পানির অ্যান্টিজেন টেস্ট কিটের একটা ট্রায়াল করা হবে। ট্রায়ালের ফলাফল পাওয়ার পর কমিটির সদস্যরা কিটের গুণগতমান মূল্যায়ন করে বাংলাদেশ ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরে পাঠাবে। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের কিটের অনুমোদন পেলে করোনা সংক্রমণ শনাক্তে মাঠপর্যায়ে কার্যক্রম শুরু হবে। করোনা নমুনা পরীক্ষায় মানুষের আগ্রহ কমেছে। নমুনা পরীক্ষায় মানুষের আগ্রহ বাড়ানো এবং আস্থা ফিরিয়ে আনতে ভালো মানের কিট আমদানি করবে স্বাস্থ্য অধিদফতর। নিম্নমানের কিট এনে আরেক দফায় মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হয়, সেজন্যই ভালোভাবে কিট যাচাই-বাছাই শেষে আমদানির উদ্যোগ নিতে চাচ্ছে সরকার।
অ্যান্টিজেন টেস্ট কিটের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম সংবাদকে বলেন, দেশের ৩৬টি জেলায় করোনার নমুনা পরীক্ষার জন্য আরটি-পিসিআর ল্যাব নেই- সেই জেলাগুলোতে অ্যান্টিজেন কিট আগে পাবে। এরপর যেসব এলাকায় করোনা সংক্রমণের হার বেশি সেসব এলাকা অ্যান্টিজেন কিট দেয়া হবে। ধাপে ধাপে প্রতিটি জেলায় অ্যান্টিজেন কিট সরবরাহের পরিকল্পনা আছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের।
তিনি বলেন, অ্যান্টিজেন কিটের ব্যাপারে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি কিট সংগ্রহ করে গুণগতমান পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য জাতীয় ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরে পাঠাবে। ওষুধ প্রশাসন কিটের গুণগতমান পরীক্ষা করে অনুমোদন দিলে স্বাস্থ্য অধিদফতর সেই কিট সংগ্রহ করবে। তবে কিট আমদানি করে যেন সমালোচনার মুখোমুখি পড়তে না হয়, সেজন্য ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরেই দেশে কিট আমদানি করা হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা সংবাদকে বলেন, অ্যান্টিজেন কিট সংগ্রহে অনেক প্রতিষ্ঠানি আসছে। তবে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা দুটি কিটের ব্যাপারে মতামত দিয়েছে- ওই দুটি কিট কেনার প্রক্রিয়া চলছে। কবে নাগাদ দেশে কিট আমদানি হতে পারে সেটি সুনির্দিষ্ট বলা যাচ্ছে না। যদিও বিশ্বব্যাপী অ্যান্টিজেন কিটে করোনার নমুনা পরীক্ষা চলছে। এজন্য কিটের সংকট হতেও পারে বলে মনে করছেন এই কর্মকর্তা।
তিনি আরও বলেন, অ্যান্টিজেন টেস্টে যাদের ফলাফল নেগেটিভ আসবে তাদের ফের আরটিপিসিআর ল্যাবে টেস্ট করে নিশ্চিত হতে হবে যে এলেই নেগেটিভ। কারণ মানবদেহে করোনার উপসর্গ থাকার পরও নিশ্চিত ফলাফলের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ভাইরাসের উপস্থিতি প্রয়োজন। অনেক ক্ষেত্রে, পিসিআরের তুলনায় প্রায় সহস্রাধিক গুণ ভাইরাসের উপস্থিতির প্রয়োজন হয়। তবে ফলাফল পজেটিভ হলে তাদের আর পরীক্ষার প্রয়োজন হবে না।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মিডিয়া উইংয়ের মুখপাত্র ডা. এবিএম শামছুজ্জামান সেলিম সংবাদকে বলেন, অ্যান্টিজেন কিটের নমুনা পরীক্ষা করতে কিছু কিট রাজধানীর মহাখালী স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইডিসিআর) এসেছে। এসব কিট দক্ষিণ কোরিয়ার এসডি বায়োসেন্সর কোম্পানির। আরও বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের কিটের নমুনা পরীক্ষা করতে আইইডসিআর এসেছে।
ডাব্লিউএইচও সোমবার (২৮ সেপ্টেম্বর) যে অনুমোদন দিয়েছে সেখানে বলা হয়েছে, ডাব্লিউএইচওর বিশেষ পার্টনারশিপ প্রগ্রামের মাধ্যমে ১২০ মিলিয়ন মানসম্পন্ন কিট নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জন্য সরবরাহ করা হবে, যার মাত্র পাঁচ ইউএস ডলার দাম পড়বে। গ্লোবাল ফান্ড এ জন্য ৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন কিট উদ্ভাবন ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাবোট ও এসডি বায়োসেন্সর কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যদিও ডাব্লিউএইচও সোমবার পর্যন্ত শুধু এসডি বায়োসেন্সরের কিট চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে আর অ্যাবোটের কিট আরও কিছুটা পর্যবেক্ষণে রয়েছে, এরপর সেটিরও অনুদোন মিলতে পারে। অ্যাবোট আমেরিকান কোম্পানি আর এসডি বায়োসেন্সর দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি।