মিতু হত্যা ভয়ঙ্কর তথ্য দিলেন মুছা
বিশ্বস্ত সোর্স কামরুল ইসলাম শিকদার মুছাকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে নিজের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে খুন করায় সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার। মিতু হত্যা মামলায় গ্রেফতার হওয়া এহতেশামুল হক ভোলার জবানবন্দিতে মুছার বরাতে এ তথ্য এসেছে, যে মুছা হত্যাকাণ্ডের পর থেকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ আছেন। যশোরের বেনাপোল থেকে বৃহস্পতিবার (২১ অক্টোবর) মিতু হত্যা মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এহতেশামুল হক ভোলাকে গ্রেফতার করে।
শনিবার (২৩ অক্টোবর) বিকেলে ভোলা চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম মোহাম্মদ সফি উদ্দিনের আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই, চট্টগ্রাম মহানগরের পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা বলেন, ‘গ্রেফতার হওয়া এহতেশামুল হক ভোলা ১৬৪ ধারায় দায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এরপর আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন।’
জানা গেছে, জবানবন্দিতে ভোলা পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের সঙ্গে পরিচয়, তার অনুরোধে মুছাকে চাকরি দেয়া থেকে শুরু করে মিতুকে হত্যার নির্দেশ পাওয়া এবং হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করা সহ বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন।
নিজেকে বালু, মুরগির খাদ্য, লাকড়ির ব্যবসায়ী উল্লেখ করে ভোলা জানিয়েছেন, জায়গা-জমি নিয়ে বিরোধের জেরে কয়েকটি মামলায় জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। সেই মামলায় সহযোগিতা পাইয়ে দেয়ার জন্য কামরুল ইসলাম শিকদার মুছার মাধ্যমে ২০০৮ সালে তৎকালীন সিএমপির কোতোয়ালী জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার বাবুল আক্তারের সঙ্গে তার পরিচয় হয়।
মুছা ছিলেন বাবুল আক্তারের বিশ্বস্ত সোর্স। মামলাগুলো থেকে তাকে অব্যাহতি পাইয়ে দেয়ায় ভোলা ডবলমুরিং থানা এলাকায় অবৈধ অস্ত্রের সন্ধান দিয়েছিলেন। সেই অস্ত্র উদ্ধার করে বাবুল আক্তার প্রশংসিত হয়েছিলেন, পদকও পেয়েছিলেন। পরে বাবুল আক্তার বদলি হলেও ২০১১ সালের দিকে আবার নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার হয়ে ফেরত আসেন।
জবানবন্দিতে ভোলা জানান, বদলি হয়ে আসার পর বাবুলের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ভোলা দেখেন সেখানে মুছা বসে আছেন। বাবুলের অনুরোধে ভোলা তার বালুর ডিপোতে মুছাকে ১৫ হাজার টাকা বেতনে ম্যানেজারের চাকরি দেন। মুছা আবার মনিরকে (পরে মিতু হত্যা মামলায় গ্রেফতার) তার কেয়ারটেকার হিসেবে নিয়োগ দেয়। বাবুল আক্তারের সোর্স হওয়ায় মুছাকে সমীহ করে চলত বলে ভোলা জবানবন্দিতে জানিয়েছে। এর কয়েকবছর পর একদিন মুছা ভোলাকে জানায় যে, বাবুল আক্তারের সঙ্গে তার স্ত্রীর ঝামেলা আছে। বাবুল আক্তার বলেছেন, তাকে যেন মুছা ফিনিশ করে দেয়’, জবানবন্দিতে এমন তথ্য দিয়ে ভোলা আরও জানান, মিতুকে খুনের কাজে মুছাকে সাহায্য করতে রাজি না হওয়ায় বাবুল আক্তার তাকে জিইসি মোড়ে মেরিডিয়ানের সামনে ডেকে নিয়ে বলেন, মুছাকে তিনি (বাবুল) একটা কাজ দিয়েছেন, ভোলা সাহায্য করতে না পারলেও যেন বাধা না দেয়, বাধা দিলে তার সমস্যা হবে। এতে ভয় পেয়ে যান ভোলা। ওইদিন বাবুল আক্তারের সঙ্গে মুছা এবং ওয়াসিমও (মামলার আরেক আসামি) ছিল।
ভোলার দাবি, কয়েকদিন পর বাবুল আক্তারের দেয়া টাকায় মুছা অস্ত্র সংগ্রহ করে। ভোলার তথ্যমতে, এর ৩-৪ দিন পর আসে ২০১৬ সালের ৫ জুন। ওইদিন সকাল ৭টা থেকে সাড়ে ৭টার মধ্যে মুছা ভোলাকে বারবার ফোন দিতে থাকে। তবে ভোলা ফোন ধরেননি। বেলা ১১টার দিকে ব্যবসায়িক কাজে খাতুনগঞ্জের শাহজালাল ব্যাংকে গিয়ে টেলিভিশনে দেখেন, পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতুকে হত্যা করা হয়েছে। তখন ভোলা মুছাকে ফোন করেন, ফোন বন্ধ ছিল। বিকেলে ভোলার অফিসে গিয়ে অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে মুছা। সে ভোলাকে বলে, তার (মুছা) কোনও উপায় ছিল না। সে যদি মিতু ভাবিকে না মারত, তাহলে বাবুল আক্তার তাকে ক্রসফায়ার দিত। তখন ভোলা বলেন, ‘এ কাজটা না করলে বাবুল স্যার হয়ত একবার ক্রসফায়ার দিত, এখন পুলিশ তো তোকে দশবার মারবে।’
মুছা ভোলার অফিসে একটি কাপড়ের ব্যাগ রেখে চলে যান। ওইদিনই তার কেয়ারটেকার মনির এসে ব্যাগটি নিয়ে যায়। ভোলার তথ্যে ডিবি পুলিশ মনিরের বাসা থেকে ব্যাগটি উদ্ধার করে। সেখানে একটি অস্ত্র ছিল। গ্রেফতার ভোলা সাড়ে তিনবছর পর জামিনে বেরিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে মুছাতে খুঁজতে থাকার তথ্য দিয়ে জবানবন্দিতে জানান, মুছাকে না পেয়ে তার স্ত্রী পান্নাকে ফোন করেন। পান্না জানান- ঘটনার কয়েকদিন পর বাবুল আক্তার মুছাকে ফোন দিয়েছিলেন। মুছাকে নাকি সাবধানে থাকতে বলে দিয়েছিল। কয়েকদিন পর আবার ফোন দিলে মুছা ক্ষেপে গিয়েছিল। সে বলেছিল, আপনার জন্য এতবড় কাজ করলাম, এখন যদি পরিবারের ক্ষতি হয় তাহলে মুখ খুলে দেব। তখন থেকে মুছা পলাতক, তাকে আর পাওয়া যাচ্ছে না। বাবুলের স্ত্রী মিতুকে কিলিং মিশনের নেতৃত্বদাতা হিসেবে অভিযুক্ত কামরুল ইসলাম শিকদার মুছা। হত্যাকাণ্ডের পরপরই ঘটনাস্থল থেকে সংগ্রহ করা ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ফুটেজে একজনকে দেখা গিয়েছিল, পুলিশ তদন্ত মুছাকে অভিযুক্ত করেছিল।