মধ্যরাতে হঠাৎ ধেয়ে আসে তিস্তার পানি, শুরু হয় উন্মত্ততা
মঙ্গলবার রাত ১২টা। ওই সময় হঠাৎ ধেয়ে আসে তিস্তার পানি। বিধবা মেয়ে আর দুই নাতিকে নিয়ে ঘরে ঘুমিয়েছিলেন জাহেরা। চরের কিনারে থাকা জাহেরা টের পান মহাবিপদের আলামত। এরপর প্রাণ বাঁচাতে চিৎকার।
ওই সময় এক লোক নৌকা নিয়ে ঘরের আঙিনায় হাজির! পরে নৌকায় চড়ে তাঁরা ছোটেন নিরাপদ আশ্রয়ে। পানি কমে যাওয়ার পর জাহেরা বাড়ি ফিরে দেখেন নেই ভিটার চিহ্ন। বাড়ির আসবাব, মালপত্র কিছুই নেই। সব গেছে তিস্তাগর্ভে। ভিটাজুড়ে এখন তিস্তার উন্মত্ততা।
কুড়িগ্রামের রাজারহাটের ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের চর গতিয়াশামে গতকাল শনিবার দুপুরে জাহেরার সঙ্গে দেখা। মেয়েকে নিয়ে কাঁদছিলেন নদীর পারে বসে। আর নিজের ভিটার দিকে তাকাচ্ছিলেন বারবার। জাহেরা বলেন, ‘আইত ১২টায় শনশন করি পানি আসছে। চিকরাচিকরি করি, কাইয়ো আগায় না। একগালা পানির পড়ি ছিলোং। নৌকা আসলে কোনোমতে বাঁচি গেছি। ঘরবাড়ি নাই, জাগাজমি নাই, কী করি? অজগবিতে পানি আসি সউগ গায়েব হয়া গেইল।’ তাঁর ছেলে শাহাদুল বলেন, ‘দুইটা ঘর ছিল, বীজ ও সার ছিল। ঘরের একটা বেড়াও পাই নাই। এখন কোন জায়গায় যামো, জানি না।’ চরে গিয়ে দেখা যায়, ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যেই সবাই বালুর নিচ থেকে টিন, আসবাব, শ্যালো মেশিন, নৌকাসহ বিভিন্ন জিনিস খুঁজছেন। কেউ কেউ ভাঙা টিনের মাথায় দড়ি লাগিয়ে টেনে তুলছেন। খাট, আলনা, টেবিলের অংশবিশেষ দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। ভেঙে পড়া কয়েকটি ঘর রাখা হয়েছে বাঁশের খুঁটি দিয়ে।
এলাকাবাসী জানায়, চরের পশ্চিম প্রান্তের ১১টি পরিবারের সব কিছু ভেঙে লুকিয়ে আছে বালুর নিচে। স্রোতের তীব্রতা এত বেশি ছিল কেউ কিছুই রক্ষা করতে পারেননি। সবহারাদের একজন শহিদুল ইসলাম। তিনি আত্মীয়-স্বজন নিয়ে বালুর নিচ থেকে মাল উদ্ধারের চেষ্টা করছিলেন। তিনি জানান, ধান, চাল, আলুসহ বাড়িতে অনেক কিছু ছিল। এখন আর কিছুই নেই। তাঁর প্রতিবেশী কাফি মিয়া জানান, চারটি ঘর, শ্যালো মেশিন, ধান, চাল সব বালুর নিচে চলে গেছে। ওই সময় ঘূর্ণিস্রোতে ডুবে যায় একটি নৌকা। গতকাল মাটি খুঁড়ে সেটি তোলার চেষ্টা চলছিল।
চরের বাসিন্দা সাহেরা বেগম জানান, বাড়িঘর সব কিছু শেষ। এখন আছেন অন্যের বাড়িতে। তাঁরা খাবার দিচ্ছেন। কোনো ত্রাণ সহায়তা না পাওয়ার অভিযোগ করেন তিনি।
গতিয়াশামের কৃষক জোবাইদুল ইসলাম জানান, ৪০ শতক জমিতে মরিচের চাষ করেছিলেন। দুই দফায় ১৫ হাজার টাকা খরচও হয়েছে। কিন্তু মরিচ ক্ষেতের ওপর এত বালু জমেছে যে অন্য ফসল আবাদের কথা ভাবতে পারছেন না তিনি। তাঁর সামনে এখন ঘোর অনিশ্চয়তা।
রাজারহাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নূরে তাসনিম জানান, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য খিচুড়ি ও শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। প্রায় তিন হাজার পরিবারকে ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
রংপুর ও লালমনিরহাটের তিস্তাপারের মানুষ নিঃস্ব : লালমনিরহাট-বুড়িমারী মহাসড়কের কাকিনাবাজার থেকে কখনো মোটরসাইকেলে, কখনো নৌকায়, কখনো হেঁটে পৌঁছানো যেত চর ইছলি। প্রায় ছয় কিলোমিটার পথের পাকা বা ইট বিছানো রাস্তা কয়েক দিন আগেও ছিল পরিপাটি। তবে গেল মঙ্গলবার রাতে আসা আকস্মিক বানের পানি লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে সব।
তিস্তার বাঁ তীরের চর ইছলি রংপুরের গঙ্গাচড়ার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের একটি গ্রাম। এর সঙ্গেই লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের চর রুদ্রেশ্বর। গতকাল দুপুরে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বাঁধহীন তিস্তার বাঁ তীর থেকে উঠে আসা প্রায় চার ফুট উচ্চতার ঢেউ অসময়ে যেন তাণ্ডব চালিয়েছে। রাস্তাঘাট ও ফসলের ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। অনেক মানুষ হয়েছে পুরোপুরি আশ্রয়হীন। এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ঘরবাড়ির অনেকাংশে। অনেকের ঘরের ভেতর থাকার উপায় নেই, কয়েক দিন ধরে শিশু-নারীসহ এসব পরিবারের লোকজন রাত কাটাচ্ছে খোলা আকাশের নিচে। জ্বলছে না চুলা, রান্না করা খাবার নিয়ে কেউ এগিয়ে এলে তাতেই মিটছে ক্ষুধা। তিস্তাপারের ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন বলছে, তিস্তার কারণে তারা এভাবে নিঃস্ব হবেন, তা কখনো ভাবেননি।
চর ইছলির হানিফ, মানিক, মোক্তার ও হাসান চার ভাই। তাঁদের বাড়িতে ঢুকে দেখা যায়, সব ঘরের মেঝে করছে জলে থইথই। শুধু ঘরগুলো দাঁড়িয়ে আছে খুঁটির ওপর। লণ্ডভণ্ড উঠানের খোলা আকাশের খাটে ঘুমাচ্ছে হানিফের এক বছর বয়সী ছেলে জুনায়েদ। মানিক বলেন, ‘বাড়িঘরের বেড়া, বিছানাসহ বাড়ির সব কিছু ভেসে গেছে পানিতে। ড্রামে রাখা চাল, হাঁড়ি-পাতিলও চলে গেছে। এখন অন্যের বাড়ি থেকে রান্না করে এনে খাচ্ছি।’ তাদের প্রতিবেশী রুদ্রেশ্বরের তাহেরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের এখন বলতে গেলে আর কিছুই নেই। বন্যায় ক্ষেতের ফসল, বাড়িতে রাখা ধান-চাল, টাকাসহ সব কিছু শেষ হয়ে গেছে।’
কালীগঞ্জের কাকিনা ইউনিয়নের বাগেরহাটে গিয়ে দেখা যায়, বন্যার তোড়ে কয়েকটি দোকান ভেঙে গেছে। ভেসে গেছে দোকানের মাল। দোকানি মোনায়েম বলেন, ‘নদীর পানি বাড়ার খবর পেয়ে বাড়ি রক্ষায় সেখানে যাই। বাড়িটা রক্ষা করতে পারিনি।’