ভেঙে যাচ্ছে স্বপ্নের দল
বিশ্ব ক্রিকেটেও এ দেশের কারও কারও থাকবে তারকাখ্যাতি। বাংলাদেশের তরুণ ক্রিকেটাররা যেমন একসময় ইমরান, কপিল, হ্যাডলি হতে চাইতেন; এ দেশেও দু-চারজন তেমন ক্রিকেটার থাকবেন; ক্রিকেট দুনিয়া যাঁদের একনামে চিনবে।
২০০৭ সালে সবার অজান্তেই সেই স্বপ্নের ভিত গড়া হয়ে যায়। মাশরাফি বিন মুর্তজার নামটা ২০০১ সাল থেকে ছড়াতে শুরু করলেও ২০০৫ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত দুই বছরে একে একে বাংলাদেশ দলে নাম লেখান মুশফিকুর রহিম, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল ও মাহমুদউল্লাহ। এরপর তো এই পাঁচে মিলেই হয়ে যান বাংলাদেশের ক্রিকেটের ‘পঞ্চপাণ্ডব’। ২০০৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে প্রথম একসঙ্গে জাতীয় দলের হয়ে মাঠে নামেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের স্বর্ণসময়ের পাঁচ সারথি। সেই থেকে একে একে ১১১টি ম্যাচে তাঁরা মাঠে নামেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। তিন সংস্করণ মিলিয়ে এই ১১১ ম্যাচের মধ্যে বাংলাদেশ জিতেছে ৫৪টিতে, ৫৩টিতে হেরেছে, ফলাফল হয়নি ৪ ম্যাচে। জয়ের সংখ্যাটা যদি কম মনে হয়, তাহলে আরও একটু পেছন ফিরে তাকাতে পারেন। ওই পাঁচজন একসঙ্গে জাতীয় দলে খেলার আগে বাংলাদেশ দল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সব মিলিয়ে ২১৮টি ম্যাচ খেলে জয় পেয়েছিল মাত্র ৪০টিতে, হার ১৭১ ম্যাচে।
২০০০ সালের শুরু পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্রিকেট যে স্বপ্নটা দেখে এসেছে, সেটাই আসলে পূর্ণতা পায় পঞ্চপাণ্ডবের সময়ে। ২০২০-এর মার্চে সিলেটে ওয়ানডে নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অলিখিত বিদায় হয়ে যায় মাশরাফির। পঞ্চপাণ্ডবের ইতিহাসেরও সেখানেই সমাপ্তি। ২০১৯ বিশ্বকাপে লর্ডসে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটাই তাই হয়ে আছে মাশরাফি, মুশফিক, সাকিব, তামিম ও মাহমুদউল্লাহকে একসঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশের শেষ ম্যাচ। ২০১৯ বিশ্বকাপের পরও বাংলাদেশ ম্যাচ জিতেছে, ভালো খেলেছে। কিন্তু দল থেকে সেই সুর-তালটা যেন হারিয়ে যেতে থাকে। বিশ্বকাপ শেষে প্রকাশ্যে মাশরাফির নেতৃত্বের সমালোচনা করেন সাকিব। সমালোচনার জবাব সরাসরি না দিলেও পরে মাশরাফিও বুঝিয়ে দেন বিষয়টি তাঁর পছন্দ হয়নি। জ্যেষ্ঠ খেলোয়াড়দের মধ্যে মন-কষাকষি, ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে বিরোধ—কিছুই আর পুরোপুরি গোপন থাকেনি এরপর। জিম্বাবুয়ে সফরে টেস্ট ক্রিকেট থেকে মাহমুদউল্লাহর আকস্মিক অবসর, টি-টোয়েন্টির প্রতি তামিম ইকবালের অনীহা, এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সমালোচনার জবাবে খেলোয়াড়দের পাল্টা ছোবল মারা সেসবেরই ধারাবাহিকতা।
পঞ্চপাণ্ডব-অধ্যায় যেমন মাশরাফি-বিয়োগে শেষ হলো, তেমনি এটাও স্বাভাবিক যে বাংলাদেশের ক্রিকেটে একদিন সাকিব-তামিম-মুশফিক-মাহমুদউল্লাহদের অধ্যায়ও শেষ হবে। হয়তো আরও কিছুদিন তাঁরা খেলবেন, তবে বাংলাদেশ দলে এই চতুষ্টয়কে আর এক সঙ্গে পাওয়ার সম্ভাবনা কমই। ওয়ানডেতে আরও কিছুদিন হয়তো তাঁদের একসঙ্গে পাওয়া যাবে, তবে সেটিও অনেক যদি-কিন্তুর ওপর নির্ভরশীল।
শচীন টেন্ডুলকার, ভিভিএস লক্ষ্মণ, রাহুল দ্রাবিড়ের বিদায়ে ২০১২ সালের পর এ রকমই সময় এসেছিল ভারতের ক্রিকেটে। ড্যামিয়েন মার্টিন, গ্লেন ম্যাকগ্রা, ম্যাথু হেইডেনের মতো অভিজ্ঞ ক্রিকেটাররা চলে যাওয়ার পর পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে অস্ট্রেলিয়া দলকেও। ভালো বিকল্প খেলোয়াড় হাতে ছিল বলেই ভারত, অস্ট্রেলিয়া পেরেছে সেই ক্রান্তিকাল কাটিয়ে উঠতে। অথচ স্বর্ণসময়ের প্রথম বৃত্তটা প্রায় পূরণ করে ফেলেও বাংলাদেশের ক্রিকেট তাকিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। স্বপ্নের দল তো ভেঙে যাচ্ছে, আরেকটি স্বপ্নের সারথিরা যে এখনো দৃশ্যপটেই নেই!